জেহাদের অনুমতি দেয়া হয়েছে সেখানেই স্পষ্ট করে বলা হয়েছে, এ আত্মরক্ষামূলক জিহাদের অনুমতি কেবল মুসলমানদের মসজিদ রক্ষার জন্য নয় বরং সমস্ত মত ও পথের লোকদের উপাসনালয়ের রক্ষার জন্য আল্লাহ এ ব্যবস্থা নিয়েছেন। আল্লাহ্ তায়ালা বলেন,
وَلَوْلَا دَفْعُ اللہِ النَّاسَ بَعْضَہُمۡ بِبَعْضٍ لَّہُدِّمَتْ صَوٰمِعُ وَ بِیَعٌ وَّصَلَوٰتٌ وَّ مَسٰجِدُ یُذْکَرُ فِیۡہَا اسْمُ اللہِ کَثِیۡرًا ؕ
وَ لَیَنۡصُرَنَّ اللہُ مَنۡ یَّنۡصُرُہٗ ؕ اِنَّ اللہَ لَقَوِیٌّ عَزِیۡزٌ ﴿۴۰﴾
...“আল্লাহ্ মানব জাতির এক দলকে অন্য দল দ্বারা প্রতিহত না করলে যেসব খ্রিস্টান সন্ন্যাসীদের বাসস্থান, গির্জা, ইহুদীদের মঠ এবং মসজিদসমূহে আল্লাহ্র নাম অধিক স্মরণ করা হয়Ñ সেগুলো বিধ্বস্ত হয়ে যেত। আর যে আল্লাহকে সাহায্য করতে উদ্যত হয় আল্লাহ্ অবশ্যই তাকে সাহায্য করেন। নিশ্চয় আল্লাহ্ শক্তিধর, মহাপরাক্রমশালী।” (সূরা হজ্জ: আয়াত ৪০)
স্পষ্ট বুঝা গেল ইসলাম ধর্মের সার্বজনিন শান্তির শিক্ষা কেবল মুসলমানদের স্বার্থ রক্ষার জন্য নয় বরং সকল ধর্মের এবং সকল মতবাদের ধর্মীয় স্বাধীনতা নিশ্চিত করার জন্য আমরা মুসলমান হিসাবে ইসলামের ভালবাসার দাবী করি এবং সেই দরদ দেখাতে গিয়ে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করি। কিন্তু আমাদের চিন্তা করতে হবে সেই প্রতিক্রিয়া কি ইসলাম সম্মত নাকি আমরা ইসলাম বিরোধী পন্থায় ইসলাম প্রতিষ্ঠার কাজ করছি। উপরোক্ত আয়াতের শিক্ষানুযায়ী মুসলমানরা অমুসলমানদের কোন উপাসনালয় ধ্বংস করতেই পারে না। আরো মজার বিষয় হলো এর আগের আয়াতে যুদ্ধের অনুমতি প্রদান করা হয়েছে। যে ধর্ম যুদ্ধাবস্থাতেও অন্যের উপাসনালয় ধ্বংস করতে নিষেধ করেছে সে ধর্ম শান্তিপূর্ণ অবস্থায় অন্যমতাবলম্বীদের উপাসনালয় কীভাবে ধ্বংস করার অনুমতি দিতে পারে? আল্লাহ্ তালা পবিত্র কোরআনের সূরা আনআমের ১০৮ নম্বর আয়াতে প্রতিমাসমূহকে গালি পর্যন্ত দিতে নিষেধ করেছেন আর উপাসনালয় ভাঙ্গা তো অনেক দূরের কথা। অতএব, ১৯৯২ সালের ডিসেম্বর মাসে উগ্র ধর্মান্ধ মৌলবাদী চক্র ধর্মের নামে যে তান্ডব চালিয়েছে তা কোন মতেই কোরআন সম্মত নয় এবং তা হুজুর (দ.)-এর পবিত্র সুন্নতেরও বিরোধী। মুওয়াত্তার যুদ্ধে সেনাবাহিনি প্রেরণের প্রাক্কালে মহানবী (দ.) সেই ইসলামী সেনা বাহিনীকে যুদ্ধক্ষেত্রে কী করণীয় আর কী বর্জনীয়Ñ এ বিষয়ে বিস্তারিত নির্দেশনা দিয়েছিলেন। এসব নির্দেশনার মাঝে হুজুর (দ.) বলেছিলেন, “চুক্তি ভঙ্গ করবে না। বিশ্বাসঘাতকতা করবে না। কোন শিশু, নারী বা অতিবৃদ্ধকে হত্যা করবে না। সন্ন্যাসী বা সাধুদেরকে হত্যা করবে না। খেজুর গাছ বা অন্য কোন গাছ কাটবে না। কোন ইমারত ধ্বংস করবে না (দ্র. সহীহ বুখারী, ২খ., পৃ. ৬১১) (সীরাত বিশ্বকোষ: ৬ষ্ঠ খন্ড, পৃষ্ঠা ২৯৬ দ্রষ্টব্য)।
যেসব ন্যাক্কারজনক ঘটনা বাংলাদেশে হিন্দুদের বিরুদ্ধে ঘটানো হয়েছিল সেগুলোর প্রামাণ্য কিছু চিত্র পরবর্তীকালে প্রকাশিত হয়েছিল শভ দেখলে মাথা হেঁট হয়ে যায়। পরবর্তীতে সরকারী পর্যায়ে সেগুলোকে ধামাচাপা দেয়া হয়েছিল বলেও জানা যায়। আজ ঠান্ডা মাথায় আমাদেরকে মূল্যায়ন করতে হবে ইসলাম বিদ্বেষী উগ্রপন্থিরা যা-ই করে থাক আমরা কি ইসলাম বিরোধী পন্থায় ইসলাম সেবা করতে পারি? অ-ইসলামী পন্থায় কি ইসলাম প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব? ইসলাম বিরোধী আচরণ করে কাউকে কি ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট করা যায়? কখনও না। অতএব, এই প্রতিক্রিয়াশীল চক্র সম্বন্ধে সকলকে সতর্ক থাকতে হবে।
আরেকভাবে বিষয়টিকে মূল্যয়ন করা যেতে পারে আর তা হলো, যদি ধরে নেয়াও হয়, সনাতনীদের এক উগ্রপন্থী অংশ নিছক গায়ের জোরে মুসলমানদের পবিত্র স্থান বাবরি মসজিদ ভেঙ্গেছে তাহলেও কিন্তু মুসলমান হিসাবে আমরা অন্যায় করতে পারি না। যেমন, রাস্তা-ঘাটে অনেক সময় পাগল নেড়ী কুকুর দেখতে পাওয়া যায়। এরা হঠাৎ ক্ষেপে গিয়ে মানুষের পায়ে কামড় দিয়ে বসে। প্রশ্ন হলো, কুকুর মানুষকে কামড় দিলেও দিতে পারে কিন্তু মানুষ কি কখনও কুকুরকে কামড় দেয়? আমাদের সাহিত্যে একটি উচ্চ মার্গের কবিতা আছে সেখানেও এ শিক্ষাটিই দেয়া হয়েছে। কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত সেখানে প্রশ্ন করেছেন,
“কুকুরের কাজ কুকুর করেছে
কামড় দিয়েছে পায়।
তাই বলে কিরে কুকুরে কামড়ানো
মানুষের শোভা পায়?”
বাবরি মসজিদকে কেন্দ্র করে উগ্রপন্থীদের পরিচালিত সমস্ত ন্যাক্কারজনক কর্মকান্ডের সঠিক প্রতিক্রিয়া ছিল এই। কিন্তু আক্ষেপ আমরা এই স্বর্ণ সুযোগকে হেলায় হারিয়েছি।
আজ আমরা যদি বাংলাদেশের অন্যান্য সম্প্রদায় বিশেষ করে হিন্দু তথা সনাতনী সম্প্রদায়কে ধর্মীয় স্বাধীনতা সত্যিকার অর্থে নিশ্চিত করতে পারতাম তাহলে আমাদের অনেকগুলো জাতীয় সমস্যা আপনা আপনি সমাধান হয়ে যেত। আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির প্রভুত উন্নতি ঘটতো, সামাজিক আস্থা ও ভ্রাতৃত্বের অনেক উন্নতি হতো এবং সর্বপরি জাতীয় ভাবমূর্তী আন্তর্জাতিক পর্যায়ে অনেক উজ্জল হতো। কিন্তু উগ্র মৌলবাদী চক্রের উস্কানীতে কান দিয়ে অ-ইসলামী পন্থায় ধর্মীয় আবেগ অনুভুতির বহিঃপ্রকাশ ঘটানোয় সামাজিক ও জাতীয় পর্যায়ে আমরা অনেক বেশী ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছি।
আমরা যদি উত্তম আচরণ ও সৌহার্দ্যপূর্ণ প্রতিক্রিয়া দেখাতাম তাহলে আমরা অনেক মানুষকে আল্লাহর সত্য ধর্মের দিকে আকৃষ্ট করতে পারতাম কিন্তু আমরা সেই সুযোগ হেলায় হারিয়েছি। এই সম্পূর্ণ আলোচনার মুদ্দা কথা হলো, ইসলাম ধর্ম ভিন্ন মতাবলম্বীদের উপাসনালয়ে আক্রমণ কোন মতেই সমর্থন করে না বরং কোরআন ও মহানবী (সা.)-এর শিক্ষায় এই গর্হিত কাজ কোঠরভাবে নিষিদ্ধ।
কেবল ১৯৯২ সালের সাম্প্রদায়িক সহিংসতার বেলায় নয়। মাত্র কয়েক মাস আগে আমাদের দেশের বিভিন্ন স্থানে হিন্দু ভাইদের মন্দিরে
যে সব ন্যাক্কারজনক আক্রমণ ও মূর্তি ভাঙ্গার মত গর্হিত অপরাধ সংঘটিত হয়েছে সেগুলোর ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। আজ থেকে
এক বছর আগে রামুতে ধর্ম রক্ষার নাম ভাঙ্গিয়ে এ মাটিরই বৌদ্ধ সন্তানদের বিরুদ্ধে যে অধর্ম করা হয়েছে সেগুলোর বেলায়ও
খাঁটি ইসলামী শিক্ষা অপরাধীদের বিরুদ্ধে ধিক্কারসহ একই রায় প্রদান করে।
وَ لَیَنۡصُرَنَّ اللہُ مَنۡ یَّنۡصُرُہٗ ؕ اِنَّ اللہَ لَقَوِیٌّ عَزِیۡزٌ ﴿۴۰﴾
No comments:
Post a Comment