যে সব খড়গ ব্যবহার করে এদেশের গ্রামে-গঞ্জে ‘মৌলোভী’ সাহেবরা সামাজিক নিপীড়ন চালিয়ে আসছেন এগুলোর মাঝে ‘তালাকের মোক্ষম অস্ত্র’টি অন্যতম। ধরুন, একজন অশিক্ষিত শ্রমিক সারাদিন গায়ে-গতরে খেটে এসে বাড়ীতে খেতে বসেছে। সামান্য কোন কথায় ক্লান্ত এ মানুষটি রেগে গিয়ে তার বউকে রাগের মাথায় গালি দিতে আরম্ভ করে। এরই এক পর্যায়ে মুখ ফসকে ‘তালাক’ শব্দটি বেরিয়ে গেল। ব্যাস, আর নিস্তার নেই। মৌলোভী সাহেবরা রাগের মাথায় উচ্চারিত এই ‘তালাক’ শব্দটিকে শিরধার্য সাব্যস্ত করে দেন আর কেবল সাব্যস্তই করেন না বরং ধর্মের সমস্ত বিধি-বিধান জলাঞ্জলি দিয়ে এ কথাকে অপ্রত্যাহারযোগ্য তিন তালাক (তালাকে বাত্তা) আখ্যা দিয়ে স্বামী-স্ত্রীকে পৃথক করে দেন। আর নিজ স্ত্রীকে ফেরত পেতে চাইলে স্বামীকে স্পষ্ট জবাব দিয়ে দেন, ‘হিলা বিয়ে’ ছাড়া সে তার স্ত্রীকে আর ফিরে পেতে পারে না। অথচ রাগের মাথায় উচ্চারিত ‘তালাক’
কোন তালাকই না। ধীর স্থিরভাবে একবার তালাক প্রদান করে তিন ‘তুহর’ (দৈহিকভাবে স্ত্রীর সুস্থ অবস্থা) অতিক্রমের মাধ্যমেই কিন্তু প্রকাশ্য তালাক (তালাকে বাইন) সম্পন্ন হয়ে যায়। এক বৈঠকে হাজার বার তালাক বললেও কিন্তু বেশীর বেশী ‘এক তালাকের ঘোষণা’ গণ্য হতে পারে। রাগের অবস্থায় প্রদত্ত হলে বিচারক নিজ বিবেচনায় ‘এটা কোন তালাকই নয়’ বলে রায়ও দিতে পারেন। এসত্ত্বেও এ ধরণের অসহনীয় নির্যাতন অহরহ ঘটেছে এবং ঘটছে। এসব কর্মকান্ডের মাধ্যমে এই শ্রেণীর হুজুররা সমাজে নিজেদের দাপট জিইয়ে রাখেন।
চলুন, দেখা যাক্ এ বিষয়ে পবিত্র কোরআনের শিক্ষা কি? পবিত্র কোরআন এ প্রসঙ্গে সবচেয়ে স্পষ্ট ও ভারসাম্যপূর্ণ শিক্ষা দিয়েছে। ‘তালাক’ চরম অবস্থায় অবলম্বন করার মত একটি পদক্ষেপ। এটা ঠাট্টার বিষয় নয়। হাদীস শরীফে এটাকে আল্লাহর দৃষ্টিতে সবচেয়ে গর্হিত হালাল (‘আবগাযুল হালাল’) বলা হয়েছে [আবু দাউদ ও ইবনে মাজা শরীফ দ্রষ্টব্য]। অর্থাৎ একান্ত অপারগতায় ভেবে-চিন্তে, অনেক দোয়া করে, ঠান্ডা ও ধীর-স্থির মস্তিষ্কে মানুষ এ পথে পা বাড়াতে পারে, তা না হলে নয়। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ্ তা’লা বলেছেন: “‘তালাক’ দু’বার (প্রত্যাহারযোগ্য)। এরপর হয় (স্ত্রীকে) নিজের করে রাখবে, না হয় বদান্যতার সাথে বিদায় দিবে।”...[সূরা বাকারা, আয়াত ২২৯]। এস্থলে স্পষ্ট জানা গেল, দু’বার তালাক দেয়ার পরও নিজ স্ত্রীকে আপন করে নেয়া যায়, আপন করার সুযোগ থাকে। আবার চাইলে এরই মধ্যে বিদায়ও করে দেয়া যায়। আয়াতটির পরবর্তী অংশে এ বিষয়ে আনুসাঙ্গিক বিষয়াবলী বর্ণনা করার পর পরের আয়াতে অর্থাৎ ২৩০ নম্বর আয়াতে আল্লাহ্ বলছেন: “সে যদি তাকে আবারও তালাক দেয় সেক্ষেত্রে সে (স্ত্রী) তার জন্য আর বৈধ হবে না যতক্ষণ সে (স্ত্রী) অন্য স্বামীর সাথে বিয়ে না করে। সে স্বামীও যদি (ঘটনাক্রমে) একে তালাক দেয় সেক্ষেত্রে এরা উভয়ে (আগের স্বামী-স্ত্রী) আল্লাহ্-নির্ধারিত সীমারেখাগুলো বজায় রাখতে পারবে বলে মনে করে বিবাহ-বন্ধনে ফেরত আসলে কোন পাপ নেই।”...এই আয়াতে স্পষ্ট করে বলা হয়েছে, তালাকদাতা স্বামী তৃতীয়বার তালাক প্রদান করলে সেই স্ত্রীকে আর সে ফেরত পাবে না। তবে স্বাভাবিক নিয়মে এই মহিলার যদি অন্যত্র বিয়ে হয় আর সে যদি ঘটনাক্রমে দ্বিতীয় স্বামীর কাছ থেকেও তালাক পেয়ে যায় (অথবা সেই স্বামীর স্বাভাবিক মৃত্যুতে বিধবা হয়) সেক্ষেত্রে উভয়ের খোদাভীরুতার আলোকে সম্মতি থাকলে এদের পুনরায় বিয়ে হতে পারে। কোন ধরণের সাজানো বা পাতানো খেলার
এখানে মোটেও কোন সুযোগ নাই। লক্ষ্য করুন, ‘হিলা বিয়ে’ বলে কোন বিয়ের এখানে উল্লেখ নেই। যেভাবে প্রথমবার ‘নিকাহ’ হয়েছিল ঠিক সেভাবেই দি¦তীয় স্বামীর সাথে ‘নিকাহ’ করার কথা বলা হয়েছে। যেভাবে প্রথম স্বামীর পক্ষ থেকে তালাক প্রদানের কথা ইতোপূর্বে বলা হয়েছে ঠিক সেভাবেই দ্বিতীয় স্বামীর ক্ষেত্রে ‘তালাক’ শব্দটি ব্যবহত হয়েছে। ভিন্ন কোন অর্থ করার কোন সুযোগ নেই। এত স্পষ্ট বিধান পবিত্র কোরআনে থাকা সত্ত্বেও হুজুররা কত জঘন্য কাজ করছে এবং করাচ্ছে! মূলের সাথে দূরতম কোন সম্পর্ক নেই, অথচ মৌলবাদীরা যুগ যুগ ধরে মূলের দোহাই দিয়ে ‘হিলা বিয়ের’ কদাচার ছড়িয়ে রেখেছে! মা হিসাবে একজন নারীর জন্য এর চেয়ে অপমানজনক বিষয় আর কী হতে পারে! অপরাধ যদি কেউ করে থাকে তা করেছে তার প্রথম স্বামী। কিন্তু হুজুররা সেই স্বামীকে কিছু না বলে উল্টো নিপিড়িত সেই নারীকেই আরেকজনের সাথে চুক্তি করা অস্থায়ী বিয়ে করিয়ে চরম অবমাননা করে এসেছে! শত-সহস্র ধিক্কার জানাই এই শ্রেণীর মৌলোভী-মোল্লাদের।
সুখের বিষয়, দেরীতে হলেও এক শ্রেণীর শিক্ষিত মানুষ ও খোদাভীরু আে এ বিষয়ে পড়াশুনা ও গবেষণা করে সঠিক সিদ্ধান্তে উপনিত হতে পেরেছেন। এঁরা হুজুরদের সমস্ত খোঁড়া যুক্তিকে কোরআন ও হাদীসের আলোকে খন্ডন করে সঠিক সিদ্ধান্ত দিয়েছেন। পাঠকদের পড়ার জন্য পবিত্র কোরআনের সংশ্লিষ্ট আয়াতদ্বয় ও ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশের ‘তালাক’ প্রসঙ্গে প্রকাশিত বিশ্বকোষের প্রবন্ধটির চয়নকৃত অংশ পাশাপাশি পোষ্ট করা হচ্ছে। দয়া করে ভালভাবে পড়ে বিষয়টি রপ্ত করে নিন যাতে মৌলবাদীদের এই ঘৃণ্য অপকর্ম থেকে সমাজকে উদ্ধার করতে পারেন।
No comments:
Post a Comment