Pages

Tuesday, September 24, 2013

মওদুদীর কথিত ধর্মরাজ্য ও মিথ্যার বেসাতি

মওদুদীর কথিত ধর্মরাজ্য ও মিথ্যার বেসাতি
জামায়াতে ইসলামীর প্রতিষ্ঠাতা ‘মাওলানা’ মওদুদী রাষ্ট্র ক্ষমতা অর্জনের জন্য সারাটা জীবন তার ‘ইসলাম’ পালন করে গেছেন। তিনি ক্ষমতা দখলের মোহে নিরীহ ধর্মপ্রাণ মুসলমানদেরকে একই নেশার আফিম খাইয়েছেন কোরআন-হাদীসের অপব্যাখ্যা করে। তার বক্তব্য ও লেখার বিভিন্ন স্থানে তিনি মহানবী (সা.) এবং তাঁর পবিত্র খলীফাদেরও নাম ভাঁঙ্গিয়েছেন নিজের এই বিকৃত ও ধিকৃত মতবাদকে সাব্যস্ত করার নিমিত্তে। মওদুদীর রচিত ‘আল-জিহাদ ফিল ইসলাম’-এ লেখা আছে, হজরত মোহাম্মদ (স.) রাষ্ট্র ক্ষমতা লাভ করার পর পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র ও সা¤্রাজ্যপতিদের প্রথমে ইসলাম গ্রহণের আহবান জানান। এ আমন্ত্রণ তারা প্রত্যাখ্যান করায় তিনি তাদেরকে যোগ্য ও ক্ষমতার হক্দার মানুষের হাতে ক্ষমতা ছেড়ে দিতে বলেন। তারা এতেও সম্মত না হওয়ায় মহানবী (স.) তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনা করে তাদেরকে অপসারণ করে তাদের দেশ দখল করে নেন। মওদুদী পরবর্তীকালে লেখা তাঁর ‘হকীকতে জিহাদ’-এ আরও একধাপ এগিয়ে দাবি করেছেন, ইসলাম গ্রহণের আমন্ত্রণ গৃহীত হয় কি হয় না-এর অপেক্ষা না করেই শক্তি লাভ করতেই হজরত মোহাম্মদ (স.) ও তাঁর দ্ইু খলীফা হজরত আবু বকর (রাযি.) এবং হজরত উমর (রাযি.) রোমীয় এবং পারস্য সা¤্রাজ্যের ওপর হাম্লে পড়েন এবং সেখানে ইসলামী রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করেন। 
পবিত্র কোরআন সম্বন্ধে যাঁর সামান্য জ্ঞানও আছে তিনি নিশ্চয়ই জানেন মওদুদদীর এই শিক্ষা কতটা কোরআন-বিরোধী! ইসলামে শান্তি ও সৌহার্দ্যরে শিক্ষা বলে যে কিছু একটা আছে মওদুদীর এসব বক্তব্য পড়ে কেউ তা ঘুনাক্ষরেও জানতে পারবে না। কিন্তু কোরআনের শিক্ষা পরিপন্থী হওয়ার পাশাপাশি তিনি যে তার বক্তব্যে কতটা সত্যের অপলাপ ও ইতিহাস বিকৃতি করেছেন সে কথাটাই এখানে তুলে ধরা উদ্দেশ্য। রোমীয় ও পারস্য
সাmম্রাজ্যের সাথে সংঘর্ষের মূল কারণগুলো এবার তুলে ধরা হচ্ছে।  

ধর্ম প্রচার বা প্রসারের জন্য নয়। আক্রান্ত হবার পর অত্যাচারীকে তার অপরাধের 
শাস্তি দেয়ার জন্য মহানবী (স.)-এর জীবদ্দশায় মু’তাহর যুদ্ধ সংঘটিত হয়। 

মু’তাহ্র যুদ্ধ: ৮ হিজরী সনের ‘জমাদিউল আউয়াল’ মাসে মহানবী (সা.) জানতে পারেন, আরব উপদ্বীপের উত্তরাংশে সিরিয়ার সীমান্ত অঞ্চলে অবস্থিত খৃষ্টান আরব গোত্রগুলো মদীনা রাষ্ট্রে আক্রমণের প্রস্তুতি গ্রহণ করছে। মহানবী (সা.) এ পে্িরক্ষতে ১৫জন সদস্যের একটি টীম সংবাদের যথার্থতা যাচাই করার জন্য সিরিয়ার সীমান্তে প্রেরণ করেন। এঁরা সিরিয়া সীমান্তে পৌঁছে সেখানে একটি সেনাদলকে জড় হতে দেখেন। এঁরা তাদেরকে ইসলাম ধর্মের তবলীগ করা আরম্ভ করেন। এর প্রতিক্রিয়ায় এই সেনাদল পনের জনের উপর আক্রমণ করে নিজেদের বিবেচনায় এঁদের সবাইকে শহীদ করে দেয়। ভাগ্যক্রমে একজন প্রাণে রক্ষা পান এবং তিনি ফেরৎ গিয়ে মহানবী (সা.)-কে সমস্ত ঘটনা জানান। এ প্রেক্ষিতে মহানবী (সা.) তাদের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান চালিয়ে প্রাপ্য শাস্তি দেয়ার পরিকল্পনা করেন। (সীরাত বিশ্বকোষ, ৭ম খন্ড, পৃষ্ঠা-৩৩২, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ।)
এরই মাঝে সংবাদ এল, সীমান্ত অঞ্চলে যে সেনাবাহিনীটি জড় হচ্ছিল তারা এখন সেখান থেকে সরে গেছে। এ কারণে হুযুর (সা.) তাঁর পরিকল্পনা সাময়িকভাবে পিছিয়ে দেন। ইতোমধ্যে, রোমীয় সম্রাটের শুরাহবীল ইবনে আমর গাস্সানী নামক আঞ্চলিক শাসক সেই অঞ্চলেই মহানবী (সা.)-র প্রেরীত একজন দূত হজরত হারেছ ব. উমায়রকে বন্দী করে নির্মমভাবে শহীদ করে দেয়। একটি রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে প্রেরীত দূতকে হত্যা করা সেই রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণারই নামান্তর। এর পরিপ্রেক্ষিতে মহানবী (সা.) হজরত যায়েদ ব. হারেসা (রাযি.)-এর নেতৃত্বে তিন হাজার সেনা বিশিষ্ট একটি বাহিনী সিরিয়ার দিকে প্রেরণ করেন। সেখানে রোমীয় সেনাদল ও এদের মিত্র খৃষ্টান আরব গোত্রগুলোর জড় করা প্রায় দু’লক্ষ সেনা সদস্যের বিশাল বাহিনীর সাথে মুসলমান সেনাদলের সংঘর্ষ হয়। এই যুদ্ধে ইসলামী সেনাবাহিনীর সেনাপতি যায়েদ ব. হারেসা (রাযি.), হজরত জাফর ব. আবু তালিব (রাযি.) ও হজরত আব্দুল্লাহ ব. রাওয়াহা (রাযি.) শহীদ হন। (ইসলামী বিশ্বকোষ, ২০শ খন্ড, পৃষ্ঠা ১, ই.ফা.বা.) 
তাবুক অভিযান: মহানবী (সা.)-র জীবদ্দশায় রোমীয় সেনাবাহিনীর (পূর্বাঞ্চল কমান্ড বায়েজিন্টাইন সাম্রাজ্য বলে পরিচিত) বিরুদ্ধে দ্বিতীয় যে অভিযানটি পরিচালিত হয়, সেটি ছিল ৯ম হিজরীর রজব মাসের তাবুক অভিযান। রসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর কাছে এক সূত্রে সংবাদ আসলো, রোমীয়রা সিরিয়ায় বিশাল সেনাবাহিনী জড় করে ফেলেছে। আর এই সেনাবাহিনীর অগ্রবর্তী দলগুলো ‘বালকা’ নামক স্থান পর্যন্ত পৌঁছে গেছে। (সীরাতুল হালাবীয়া (উর্দু), ৩য় খন্ডের প্রথমাংশ, পৃষ্ঠা ৩৯৫, গাযওয়ায়ে তাবুক পর্ব, দারুল ইশায়াত, করাচী, ১৯৯৯, সিরাত বিশ্ব কোষ ৭ম খন্ড, পৃ ৫২২, ই.ফা.বা.)
অপরদিকে আরবের খৃষ্টানরা রোমান স¤্রাটকে এক পত্রে জানায়, মোহাম্মদ (স.) মৃত্যুবরণ করেছেন। এখন মদিনায় প্রচন্ড গরম অভাব-অনটন ও দুর্ভিক্ষ চলছে। এই মুহূর্তে অভিযান পরিচালনা করলে সহজে মদীনা দখল সম্ভব হবে। হিরাক্লিয়াস পত্র প্রাপ্তির পর চল্লিশ হাজার সৈন্যের অগ্রবর্তী দল প্রেরন করে। [মাজমাউয জাওয়াইদ, ৬ষ্ঠ খন্ড পৃষ্ঠা-১৯১; শিবলী নুমানীর সীরাতুন্নবী ১ম খন্ড, পৃষ্ঠা-৩২৩; সীরাত বিশ্বকোষ, সপ্তম খন্ড, পৃষ্ঠা-৫২৩, ই.ফা.বা.] 
শত্রু সেনাদের এই আগ্রাসনকে প্রতিহত করার জন্য আল্লাহ্র রসূল (সা.) তিন হাজার সদস্যের একটি বাহিনী নিয়ে সিরিয়ার সীমান্ত অঞ্চলে গিয়ে উপস্থিত হন (সীরাত হালাবিয়া, পৃষ্ঠা ৪০২)। কিন্তু সেখানে পৌঁছানোর পর জানা গেল এই সংবাদটি নিছক রটিয়ে দেয়া একটি গুজব ছিল। সে সময় প্রচন্ড গরম পড়েছিল, দীর্ঘ ও কঠিন পাঁচ দিনের পথ অতিক্রম করে তিন হাজার মুসলমান সেনা শত্রু অঞ্চলে উপস্থিত হয়েছিলেন, শত্রুপক্ষও অপ্রস্তুত ছিল। অতর্কিত আক্রমণ চালিয়ে সেই অঞ্চলের অমুসলিম শাসকদের মূলোৎপাটন করার মোক্ষম সুযোগ পেয়েও তিনি (সা.) ২০দিন সেখানে অবস্থান শেষে ইসলামী সেনাদলকে মদীনায় ফেরত নিয়ে আসলেন। কিন্তু কেন?
মাওলানা মওদুদীর কথা অনুযায়ী মহানবী (সা.)-র শিক্ষা যদি আগ্রাসী ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে অমুসলিম দেশগুলোকে যুদ্ধ করে জয় করে নেয়াই হয়ে থাকে, তাহলে তাবুকের অভিযানে সম্মুখ সমরে লিপ্ত হওয়া আবশ্যক ছিল। কিন্তু মহানবী (সা.) এমনটি করেন নি। বরং যুদ্ধে লিপ্ত হবার কোন যৌক্তিক কারণ না থাকায় ২০দিন পর্যন্ত শক্রপক্ষকে সার্বিক পর্যবেক্ষণ করে তিনি তাঁর বিরাট সেনাদলকে সঙ্গে নিয়ে ফেরত চলে আসেন (সীরাত হালাবিয়া, পৃষ্ঠা ৪৩৬)। প্রমাণিত হল, মহানবী (সা.) রোমীয়দের রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করার উদ্দেশ্যে অভিযানে যান নি। 

হজরত আবু বকর সিদ্দীক (রাযি.)-এর খিলাফতকালের
যুদ্ধ ও অভিযানগুলোর প্রেক্ষাপট

মৃত্যুর মাত্র কয়েক সপ্তাহ আগে মহানবী (সা.) আবার সংবাদ পেলেন, রোমীয় সাম্রাজ্যের অধীনে সিরিয়ার সীমান্তবর্তী অঞ্চলে সামরিক আগ্রাসনের প্রস্তুতি চলছে। বিশ্বনবী মোহাম্মদ মোস্তফা (সা.) নিজ জীবদ্দশাতেই এই আগ্রাসনকে প্রতিহত করার জন্য হজরত উসামা ব. যায়েদ (রাযি.)-এর নেতৃত্বে একটি সেনাবাহিনী সিরিয়ার উদ্দেশ্যে প্রেরণের আদেশ প্রদান করেন। কিন্তু এরই মধ্যে মহানবী (সা.)-র মৃত্যু সংঘটিত হলে এই সিদ্ধান্তের বাস্তবায়ন ঘটে হজরত আবু বকর (রাযি.)-এর খিলাফতকালে। এই সেনাদল ১১শ হিজরী সনের রবিউস সানির ১লা তারিখে অভিযান পরিচালনা করে ৭০দিনের (আলবিদায়া ওয়ান নিহায়া অনুযায়ী ৭০ দিন এবং ইবনে কাসীরের অনুযায়ী ৪০ দিন) মধ্যেই রোমীয়দের বিরুদ্ধে সাফল্য ও বিজয় লাভ করে ফেরত আসে। কিন্তু এরই মাঝে মক্কা শরীফ, মদীনা মনোয়ারা ও তায়েফ ছাড়া আরবের অবশিষ্ট অঞ্চলে মহানবী (সা.)-র তিরোধানে সশস্ত্র বিদ্রোহ মাথাচাড়া দেয়। অনেকগুলো গোত্র মদীনা রাষ্ট্রে যাকাত দিতে অস্বীকৃতি জানায়, নবুওয়তের কয়েকজন মিথ্যা দাবিদার তাদের গৌত্রীয় সমর-শক্তিসহ আগ্রাসী ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। 
আরব উপদ্বীপের অভ্যন্তরীণ এই সমস্ত বিদ্রোহের পাশাপাশি রোমীয় ও পারস্য সাম্রাজ্যের পক্ষ থেকে আক্রমণের ভয়াবহ আশঙ্কা দেখা দেয়। এই উভয় সাম্রাজ্যের সীমান্তবর্তী অঞ্চলে এরা তাদের মিত্র গৌত্রগুলোকে ইসলামী রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে উস্কানীমূলক আচরণ করতে উৎসাহিত করে। এ কারণে হজরত আবু বকর সিদ্দীক (রাযি.) একদিকে রোমীয় সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান প্রেরণ করেন এবং তদানীন্তন ইরাকের ভেতরেও পারস্য সাম্রাজ্যের মিত্রদের দমন করার জন্য সেনা অভিযান চালান। অর্থাৎ এ সমস্ত সেনা ও সামরিক অভিযান কারও সাম্রাজ্য দখল করার উদ্দেশ্যে প্রেরীত হয় নি বরং তাদের আক্রমণ ও অনিষ্ট থেকে নিজেদের জনগন ও রাষ্ট্রকে রক্ষা করার উদ্দেশ্যে পরিচালিত হয়েছিল। (দেখুন আত্ তাবারি, ৩য় খন্ড, পৃষ্ঠা ২১৭, তারিখু খালিদ ই.ওয়ালিদ, পৃষ্ঠা ৯৪, ইসলামী বিশ্ব কোষ, ২২তম খন্ড, পৃষ্ঠা ৪০৫, ই.ফা.বা) 
এসব ঐতিহাসিক সত্য ও তথ্য যা নির্ভরযোগ্য ও প্রামাণ্য দলিল-প্রমাণ দ্বারা সাব্যস্ত, সর্বোপরি কোরআন ও মহানবী (সা.)-র সুন্নত দ্বারা সমর্থিত সর্বোতভাবে মাওলানা মওদুদী ও তার সমমনাদেরকে ভ্রান্ত ও ভ্রষ্ট সাব্যস্ত করছে। আল্লাহ্ তায়ালা মুসলমানদেরকে মওদুদীবাদী অপব্যাখ্যার খপ্পর থেকে রক্ষা করুন। 

হজরত উমরের পারস্য অভিযান

ইরানে আক্রমণ করার প্রেক্ষাপট বুঝার জন্য স্পষ্ট হওয়া প্রয়োজন, সে যুগের দুই পরাশক্তির মাঝে ইরান ছিল একটি। মুসলমান সেনাবাহিনী যখন তৎকালীন অপর পরাশক্তি রোমীয়দের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হতে বাধ্য হয়েছিল সে সুযোগটি কাজে লাগিয়ে তখন সীমান্তবর্তী ইরানী সেনাদলগুলো এবং সীমান্তবর্তী গৌত্রীয় নেতারা মুসলিম রাজ্যের সীমান্তবর্তী অঞ্চলে আক্রমণ চালানো আরম্ভ করে দেয়। তারা নিশ্চিত ছিল, মুসলমান সেনাদল যেহেতু রোমীয় পরাশক্তির সাথে সম্মুখসমরে লিপ্ত তাই তাদের সাথে যুদ্ধে রত হবার মত শক্তি তারা রাখে না। অর্থাৎ একই সময় দু’টো প্রতিপক্ষের সাথে যুদ্ধ মুসলমানরা করতে পারবে না-এই ছিল তাদের ধারণা। তাই তারা নির্বিঘেœ মুসলমান অধ্যুষিত অঞ্চলগুলোতে প্রবেশ করে লুট-পাট ও হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে অনায়াসে ফেরত চলে যেতে লাগলো। এই পরিস্থিতিতে নিজের দেশ ও জনগণকে রক্ষা করার জন্য এবং রোমীয় পরাশক্তির সাথে যুদ্ধরত থাকা সত্ত্বেও আত্মরক্ষার্থে হজরত উমর (রাযি.) ইরানকে প্রতিহত করার সিদ্ধান্ত নেন। এই সিদ্ধান্তই হজরত উমরের চরম অপারগতা সাব্যস্ত করছে। তা না হলে স্বাভাবিক অবস্থায় কোন রাষ্ট্র বা বিচক্ষণ রাষ্ট্রনায়ক একই সময় দু’টি পরাশক্তির সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হতে পারে না। এরই ফলশ্রুতিতে পর্যায়ক্রমে ইরানী সেনাদলের সাথে মুসলমান সেনাবাহিনীর যুদ্ধ আরম্ভ হয়ে যায়। আর এর পরিণতিতে ইরানী সা¤্রাজ্য ভেঙে খান্ খান্ হয়ে যায়। 
এমনই একটি যুদ্ধে ‘জালুলা’ নামক স্থানে মুসলমান সেনাদল পারস্য সেনাদলের বিরুদ্ধে এক বিরাট বিজয় লাভ করে। মুসলমান সেনাদলের সেনাপতি এই বিজয়ের সুসংবাদ হজরত উমর (রাযি.)-এর কাছে প্রেরণ করার পাশাপাশি আরও অগ্রসর হবার অনুমতি প্রার্থনা করেন। প্রত্যুত্তরে হজরত উমর (রাযি.) তাঁকে আর অগ্রসর হতে কঠোরভাবে নিষেধ করে বলেন, আমার একান্ত কামনা হলো, তাদের এবং আমাদের মাঝে যেন এমন একটি অন্তরায় থাকে যার ফলে তারা আমাদের দিকে আর আমরা যেন তাদের দিকে অগ্রসর হতে না পারি। [তারিখে তাবারী, ৪র্থ খন্ড, পৃষ্ঠা ২১৬, যিকরুল খবর আন ওয়াকওয়াতে জালুলা, ষোড়শ হিজরী সন, দারুল ফিকর বয়রুত থেকে ২০০২ সনে মুদ্রিত]
পারস্য সা¤্রাজ্যের অধীনস্থ খোরাসান অঞ্চলে মুসলমান সেনাদলের অসাধারণ বিজয় সংবাদ যখন সেনাপতি আহনাফ বিন কায়স হজরত উমর (রাযি.)-এর কাছে পাঠালেন তখনও খোরাসান বিজয়ের সংবাদ শুনে আনন্দে উদ্বেলিত হন নি হজরত উমর (রাযি.)। বরং তিনি আক্ষেপ করে বলেছিলেন, ‘হায়, আমি সেখানে সেনা অভিযান পরিচালনা না করলেই ভাল ছিল! হায়, আমাদের আর তাদের মাঝে আগুনের একটি সমুদ্র অন্তরায় হয়ে দাঁড়ালে কত ভাল হতো! [তারিখে তাবারী,খন্ড  ৪র্থ, পৃষ্ঠা ৩৮, যিকরু মাসীর ইয়াযদাজার্দ খোরাসান, ২২ হিজরী, প্রাগুক্ত মুদ্রণ] 
উপরোক্ত অবস্থা ও পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে এবং হজরত উমর (রাযি.)-এর এসব অভিব্যক্তির আলোকে একথা স্পষ্ট হয়ে যায়, ইরান অধ্যুষিত অঞ্চলে একান্ত অপরাগ হয়ে আক্রমণ চালাতে হয়েছে, তা না হলে হজরত উমর (রাযি.) আক্রমণ করার পক্ষে ছিলেন না। মওদুদী সাহেবের দাবিটিকে সত্য বলে মেনে নিলে হজরত উমর (রাযি.) এবং সে যুগের প্রতিটি মুসলমানের সাগ্রহে সানন্দে ইরানকে আক্রমণ করার কথা ছিল। কিন্তু বাস্তবতা ও ঐতিহাসিক সাক্ষ্য-প্রমাণ এর সম্পূর্ণ  বিপরীত। 
তৃতীয় খলীফা হজরত উসমান (রাযি.)-এর খিলাফতকালের প্রথম কয়েক বছরের মধ্যেই এসব অঞ্চল সম্পূর্ণভাবে করতলগত হয়। এর ফলশ্রুতিতে হজরত উসমানের অবশিষ্ট খিলাফতকাল ও হজরত আলী (রাযি.)-র সম্পূর্ণ খিলাফতকালে আর কোন অমুসলিম রাষ্ট্রে বা দেশে আক্রমণ রচনা করা হয়নি। তা না হলে, সে যুগে আরও শত শত অমুসলিম দেশ ও রাষ্ট্র বিদ্যমান ছিল। মওদুদীর কথা সঠিক বলে মেনে নিলে অর্থাৎ অমুসলমান রাষ্ট্রগুলোকে করায়ত্ত্ব করে সেখানে ‘ইসলামী রাজত্ব’ প্রতিষ্ঠা করার দাবীকে সত্য বলে মেনে নিলে আমাদেরকে এ কথাও স্বীকার করতে হবে, খোলাফায়ে রাশেদীনের অর্šÍভুক্ত দু’জন খলীফা হজরত উসমান ও হজরত আলী (রাযি.) ইসলামের মৌলিক শিক্ষাকে অগ্রাহ্য করে অপরাধ করেছেন (নাউযুবিল্লাহ মিন যালিকা)॥ অতএব মওদুদীর দর্শন মিথ্যা সাব্যস্ত হল। 
তবে হ্যা, এক্ষেত্রে ধর্মপ্রাণ মুসলমানদেরও দায়-দায়িত্ব আছে। মওদুদীর সব কথাই যে সত্য বলে মেনে নিতে হবে একথা কিন্তু তিনি নিজেও দাবী করেন না। বরং তিনি ‘তরজুমানুল কোরআন’ মে, ১৯৫৮ সংখ্যায় শিক্ষা দিয়ে গেছেন: ‘বাস্তব জীবনে এমন কিছু চাহিদা ও প্রয়োজন আছে যেসব ক্ষেত্রে মিথ্যা কথা বলা কেবল বৈধ নয় বরং আবশ্যক বলে ফতোয়া দেয়া আছে।’ যার জীবনের একমাত্র লক্ষ্য ও  উদ্দেশ্য হচ্ছে ‘ক্ষমতা দখল’ সে এই মহৎ উদ্দেশ্য সাধনের লক্ষ্যে একটু আধটু মিথ্যা কথা বলতেই পারে। ‘সত্য’ প্রতিষ্ঠাকল্পে মিথ্যা বলতে ক্ষতি কি!

No comments:

Post a Comment